কোনো অংকের একটিমাত্র সমাধান থাকতে পারে না! সেই ভাবনা তার শৈশব থেকে। যেই ভাবনা সেই কাজ। স্কুলের শিক্ষক একটি নিয়মে অংকের সমাধান করে দিলেও তিনি বাসায় ফিরে কয়েক নিয়মে সেই অংকের সমাধান করতেন। পরদিন গিয়ে দেখাতেন স্কুল শিক্ষককে। স্কুল শিক্ষক দেখে চমকে গিয়ে বলেছিলেন, “একদিন তুমি অনেক বড় হবে।”
আমরা কথা বলছি বাংলাদেশী পদার্থবিজ্ঞানী এম. জাহিদ হাসানকে নিয়ে। শিশুকাল থেকে যার এমন মেধা তিনিই তো বিশ্বজোড়া খ্যাতি অর্জন করবেন এটাই স্বাভাবিক। কয়েকটি বিষয় আবিষ্কার করলেও তিনি মূলত অধরা কণার বিজ্ঞানী হিসেবে সম্যক পরিচিত।
ছোটবেলায় বঙ্গবন্ধু তাকে কোলে নিয়ে বলেছিলেন, “এই ছেলে একদিন অনেক বড় হবে। ওর জন্য আমার অন্তহীন আশির্বাদ রইলো।” এই ছোট্ট শিশুটির বড় হবার গন্ডি দেশেই সীমাবদ্ধ থাকেনি। দেশের গন্ডি পেরিয়ে তার খ্যাতি এখন বিশ্বজোড়া।
তার জন্ম ও বেড়ে উঠা ঢাকা শহরেই। তিনি ১৯৮৬ সালে মেধাতালিকায় দ্বিতীয় স্থান অধিকার করে এসএসসি পাশ করেন ধানমন্ডি সরকারি বালক উচ্চ বিদ্যালয় থেকে। এইচএসসিতেও রাখেন মেধার স্বাক্ষর। ১৯৮৮ সালে মেধাতালিকায় প্রথম স্থান অধিকার করে ঢাকা কলেজ থেকে এইচএসসি পাশ করেন৷ বাবা-মায়ের প্রবল ইচ্ছা ছিলো ছেলেকে ডাক্তার বানাবেন। কিন্তু বাঁধ সাধলো ছেলের ইচ্ছা নিয়ে। ছেলের আগ্রহ যে পদার্থবিজ্ঞানে। নিজের আগ্রহ আর ইচ্ছা নিয়ে ভর্তি হয়ে যান ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের পদার্থবিজ্ঞান বিভাগে। কিন্তু সেই বছরই স্কলারশিপ নিয়ে চলে যান ইউনিভার্সিটি অব টেক্সাসে।
সেই থেকে তার সফলতার শুরু। পদার্থবিজ্ঞানে একেক পর এক ডিগ্রি জমা হতে থাকে তার ঝুলিতে। পদার্থবিজ্ঞানের জগতে নিজেকে একজন জাঁদরেল গবেষক হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করতে সক্ষম হন তিনি।
সেখানে গিয়ে নোবেল বিজয়ী তত্ত্বীয় পর্দাথবিজ্ঞানী স্টিফেন ভাইনভার্গের নিকট শিক্ষা গ্রহনে সুযোগ হয় তার। তারপর মাস্টার্স ও পিএইচডি করতে চলে যান স্টানফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয়ে। তখন থেকেই পদার্থবিজ্ঞানের জগতে তার খ্যাতি ছড়িয়ে পড়ে। অনেক খ্যাতিমান পদার্থবিজ্ঞানীর সাথে তিনি কাজ করার সুযোগ পান, যার মধ্যে অনেকেই ছিলেন নোবেলজয়ী। পিএইচডি করার সময় ড.জাহিদ বের করেন কঠিন বস্তুর মধ্যে ইলেকট্রনের চারটি কোয়ান্টাম সংখ্যা বের করার কৌশল।
এরইমধ্যে তিনি বিশেষ আমন্ত্রণে লেকচার দিতে যান প্রিন্সটন ইউনিভার্সিটিতে। তার লেকচার শুনে সেদিনই তাকে প্রিন্সটন ইউনিভার্সিটিতে শিক্ষক হিসেবে যোগদানের আমন্ত্রণ জানানো হয়। এই সম্পর্কে তিনি বলেন, “আমি একটা বক্তব্য দিতে গিয়েছি প্রিন্সটনে৷ বক্তৃতা শেষেই তারা আমাকে যোগদানের আমন্ত্রণ জানান। সেসময় আমার কোনো জীবনবৃত্তান্ত তৈরি ছিলো না। পিএইচডিও শেষ হয়নি।”
ছোটবেলা থেকেই তিনি মেধার স্বাক্ষর রেখেছিলেন। মাত্র ১৬ বছর বয়সে সবাইকে চমকে দিয়ে প্রকাশিত করেছিলেন বিজ্ঞান বিষয়ক তার প্রথম বই “এসো ধুমকেতুর রাজ্যে।” সেই সময় বইটি অনেক সাড়া ফেলেছিলো। স্বয়ং বাংলা সাহিত্যে বিজ্ঞানের পথিকৃৎ আবদুল্লাহ আল মুতী তার এই বইটি পড়ে অনেক প্রশংসা করেছিলেন। বই প্রকাশের পাশাপাশি তিনি বিজ্ঞান সাময়িকীতে নিয়মিত লিখতেন।
অধরা কণার অস্তিত্বের কথা প্রথম জানিয়েছিলেন বিজ্ঞানী হারম্যান ভাইল। তার নামানুসারে একে “ভাইল ফার্মিয়ন” নামকরণ করা হয়। তাও প্রায় অনেক অনেক বছর আগের কথা। ১৯২৯ সালে তিনি এই অস্তিত্বের কথা সবাইকে জানিয়েছিলেন। সেই থেকে বিশ্বের অনেক পদার্থবিজ্ঞানী সেটির অস্তিত্ব প্রমাণের চেষ্টা চালালেও সফল হতে পারেননি কেউই।
সেই গবেষণায় সফলতার মঞ্চে প্রথম পা দিয়েছেন বাংলাদেশী বিজ্ঞানী ড.জাহিদ হাসানের নেতৃত্বে গবেষক দল। তারা দীর্ঘদিন পরে বের করেছে বহুল প্রতীক্ষিত “ভাইল ফার্মিয়ন” কণার অস্তিত্ব। যা কেবল তত্ত্বীয় পদার্থবিজ্ঞান নয় ইলেকট্রনিক ও কম্পিউটার দুনিয়ায় বৈপ্ল¬বিক পরিবর্তন আনতে সক্ষম।
প্রতিনিয়তই বদলাচ্ছে ইলেকট্রনিক ও কম্পিউটারের জগৎটা। ড.জাহিদের আবিষ্কার এক্ষেত্রে আরো অগ্রণী ভূমিকা পালন করবে। এর অগ্রগতিতে ভূমিকা রাখবে কল্পনাতীত।
আমাদের পৃথিবীর সবকিছুই ক্ষুধাতিক্ষুদ্র কণার পিন্ড। বিজ্ঞানীরা এই কণাকে দুটি ভাগে ভাগ করেন। একটি হচ্ছে বোসন কণা। যার আবিষ্কারক বাঙালি বিজ্ঞানী সত্যেন্দ্রনাথ বসু। তার নামানুসারেই এর নামকরণ করা হয় বোসন কণা। অন্যটি হলো ফার্মিয়ন কণা। “ভাইল ফার্মিয়ন” হলো ফার্মিয়ন কণার একটি উপদল।
ভাইল ফার্মিয়ন কণার কোনো ভর নেই। ভর না থাকার কারণে এটি ইলেকট্রনের বিপরীতধর্মী আচরণ করে। ইলেকট্রন পথ চলতে গিয়ে ছড়িয়ে পড়লেও ভাইল ফার্মিয়ন কণা ছড়িয়ে পড়ে না। এটি একই সঙ্গে চৌম্বকের একক মেরু (মনোপোল) এবং বিপরীত একক মেরুর (অ্যান্টি-মনোপোল) বৈশিষ্ট্য বহন করে। এই কারণে সেগুলো ইলেকট্রনের মতো ছড়িয়ে না গিয়ে এর পথ বজায় রাখে। এই আবিষ্কার ইলেকট্রনিকস সামগ্রীতে ব্যবহার করলে এর অগ্রগতি হবে কল্পনাতীত৷ আমাদের অধিক ব্যবহারের ফলে ইলেকট্রনিক সামগ্রীতে যে তাপ উৎপন্ন হতো এই প্রযুক্তি ব্যবহার করলে সেই তাপ আর উৎপন্ন হবে না। এটি ইলেকট্রনিক সামগ্রীর গতি বাড়াবে, করবে শক্তি সাশ্রয়ী।
চট্টগ্রামের লালদীঘি ময়দানে ড.জাহিদকে একবার সংবর্ধণা দেয়া হয়। সেখানে উপস্থিত ছিলেন বাংলাদেশের নোবেলজয়ী অর্থনীতিবিদ ড.ইউনুস। তিনিও দেখতে পেয়েছিলেন পদার্থবিজ্ঞানের জগতে ড.জাহিদের অদূর সম্ভাবনা।
সেই সম্ভাবনাকে কাজে লাগিয়ে তিনি সবার সামনে নিয়ে এসেছেন নতুন আরেকটি চমক। সবাইকে অবাক করে দেওয়া তার এই নতুন চমকের নাম,“টপোলজিক্যাল ক্যাগোমে কোয়ান্টাম চুম্বক।”
তোমাদের যদি বলা হয় তোমাদের কম্পিউটার বর্তমান থেকে শতগুণ বেশি ক্ষমতাসম্পন্ন হয়ে যাবে তোমরা একটু অবাক হয়ে যাবে তাই না! অবাক হওয়ার কিছুই নেই ড.জাহিদের আবিষ্কৃত ক্যাগোমে কোয়ান্টাম চুম্বকের কাজই এটি। তোমাদের কম্পিউটাটকে বর্তমান থেকে শতগুণ শক্তিসম্পন্ন আর নিখুঁত করে তুলবে তার এই আবিষ্কারটি।
ন্যানো টেকনোলজিতে এক ধরনের বিপ্ল¬ব আনতে পারে “ক্যাগোমে কোয়ান্টাম চুম্বক।” ধরো তোমার কম্পিউটারে যে মেমোরি বা হার্ডডিস্ক আছে এই প্রযুক্তি সেই স্টোরেজকে শতগুণ বেশি ক্ষমতাসম্পন্ন করবে। অর্থ্যাৎ, মেমোরি কার্ড কিংবা স্টোরেজ আকারে ছোট হবে কিন্তু এর ধারণ ক্ষমতা হবে ১০০ গুণ।
জাপানিদের নিকট ক্যাগোমে নামটি কিছুটা পরিচিত কারণ এটি তাদের একটি বাস্কেট ডিজাইন প্যাটার্ন। প্যাটার্নটা তারা অনেক আগে আবিষ্কার করলেও টপোলিক্যাল কোয়ান্টাম চুম্বক তারা আবিষ্কার করতে পারেনি। যা করে দেখিয়েছেন বাংলাদেশী বিজ্ঞানী ড. জাহিদ হাসান।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তির পরে বিশ্ববিদ্যালয় তাকে আর টানতে পারেনি। কারণ হিসেবে তিনি বলেছিলেন সেসময় বিশ্ববিদ্যালয় এলাকায় খুব মারামারি হতো। যা তার কাছে অপছন্দের ছিলো। তিনি মাত্র চারদিন ক্লাস করেছিলেন। সেই বছরই স্কলারশীপ নিয়ে পাড়ি জমান অস্টিনের টেক্সাস বিশ্ববিদ্যালয়ে।
ড.জাহিদ বর্তমানে বার্কলি ইন্টারন্যাশনাল ল্যাবরেটরিতে গবেষক হিসেবে কর্মরত আছেন। তিনি স্নাতকে কৃতিত্বের জন্য ১৯৯০ সালে আমেরিকার প্রেসিডেন্সিয়াল অ্যাওয়ার্ড লাভ করেন। ২০০৮ সালে কোয়ান্টাম মেথডের জন্য পান ক্রিয়েটিভিটি এক্সটেনশন অ্যাওয়ার্ড, ফেলোশিপ অ্যাওয়ার্ড।
প্রিন্সটন বিশ্ববিদ্যালয় বাদেও আইনস্টাইন, নিলস বোর ও ওপেন হাইমারের বিশ্ববিদ্যালয়েও শিক্ষকতা করেন ড.জাহিদ। শিক্ষকতা করেন ইউনিভার্সিটি অব ক্যালিফোর্নিয়াতেও। এরইমধ্যে প্রায় ২০ জন শিক্ষার্থী তার তত্ত্বাবধানে পিএইচডি ডিগ্রি লাভ করেছেন।
১৯৯৮ সাল থেকে এ পর্যন্ত প্রায় একশটি দেশে আড়াইশত আন্তর্জাতিক সেমিনারে লেকচার দেন তিনি। বিশ্ববিখ্যাত ল্যাবরেটরি সার্ন, লরেন্স বার্কলে, ব্রোকহেভেন ন্যাশনাল ল্যাবে কাজ করার সুযোগ হয়েছে ড.জাহিদের। যুক্ত আছেন সৌদি আরবের কিং আব্দুল আজিজ বিশ্ববিদ্যালয়সহ বাংলাদেশের নর্থ সাউথ ইউনিভার্সিটির সাথে।
বাংলাদেশীদের সম্পর্কে ড. জাহিদ হাসান বলেন, “জাতি হিসেবে আমি সবাইকে চিন্তা করতে বলি। এই জাতির অনেক সম্ভাবনা আছে। তরুণদের সঠিক পরিচর্যা, প্রশিক্ষণ ও সুবিধা দিলে একজন নয়, এরকম হাজার হাজার বিজ্ঞানীর জন্ম হবে।”
অধরাকণা আবিষ্কার করার পরে হঠাৎ করেই গুঞ্জন উঠেছিলো ড.জাহিদের নোবেল পুরষ্কার পাবার কথা। যদিও তার বাবা বিশ্বাস করেন তার ছেলে একদিন নোবেল পুরষ্কার পাবেই। তার বাবার মতো আমরাও বিশ্বাস করতে চাই অচিরেই বাংলাদেশের বিস্ময়বালক ড.জাহিদ হাসান প্রথম বাংলাদেশী বিজ্ঞানী হিসেবে নোবেল পুরষ্কারের খাতায় তার নাম লিপিবদ্ধ করবেন।