আত্মসম্মান-সুমাইয়া তানজিল

আপাতত আমি ভাইভা বোর্ডে বসা। আমার সামনে বসে আছে তিনজন ব্যক্তি। একজন আমাকে প্রশ্ন করছে। আর যে প্রশ্ন করছে সে হচ্ছে আমার স্কুলের আমার সাথে একই ক্লাসে পড়া এক ছেলে। নাম ইমন। যাকে একদিন আমরা কয়েকজন বন্ধু মিলে খুব অপমান করেছিলাম। সেই দিনই শুনেছিলাম সে স্কুল ছেড়ে দিয়েছিলো। সেই তখন ক্লাস সিক্সে পড়তাম। আজ এই ষোলো বছর পর আবার তার সাথে দেখা আমার। ভাইভা দিচ্ছি কিন্তু ভয়ে আমার গলা শুকিয়ে যাচ্ছে। বাইরে এখনও যথেষ্ট শীত হালকা ঘেমেই গেছি। ইমন আমার দিকে এক গ্লাস পানি এগিয়ে দিয়ে বললো,

-আপনি কি নার্ভাস?  ভয় পাচ্ছেন কেন?  এই নিন পানি খান।

-না স্যার, আমি নার্ভাস নয়। থ্যাংকস।

-পানিটা খেয়ে নিন। ভালো লাগবে।

-জ্বী। পানি খেয়ে আমি একটু শান্ত হলাম।

ভাইভা শেষ করে বাইরে গেলাম। কংক্রিটের রাস্তার উপর হাঁটছি। ভাবছি বাবাকে কি বলবো!  জানি তো চাকরিটা হবে না। কারণ যাকে আমি অপমান করেছিলাম। আমার কারণে যে স্কুল ছেড়ে দিয়েছিলো। আর সে কিনা আমাকে চাকরি দিবে! এটা ভাবা অসম্ভব। মাথা নিঁচু করে বাসায় ঢুকলাম। বাবাকে সরাসরি বললাম আমার চাকরিটা হবে না বাবা। আমি ভাইভাতে অনেক খারাপ করেছি। বাবার চোখ নিচে ছিলো তাকাতে পারছিলাম না আমি বাবার দিকে। নিজেকে আজ খুব অপদার্থ মনে হচ্ছে। রুমে চলে আসলাম। নিজের উপর খুব বিরক্তবোধ থেকেই দরজা বন্ধ করে লাইট বন্ধ করে শুয়ে পড়লাম। ঘুম থেকে উঠলাম যখন, দেখি সকাল হয়ে গেছে। কাল সন্ধ্যাবেলায় ঘুমিয়েছিলাম। ফ্রেশ হয়ে ডাইনিংয়ে গেলাম। দেখলাম মা-বাবা সকালের নাস্তা করছে। আমিও সকালের নাস্তা করে কোনো কথা বলা ছাড়াই আবার নিজের রুমে চলে আসলাম। ফোন চেক করতেই দেখি আমাকে অফিস থেকে টেক্সট করা হয়েছে। যেই অফিসে কাল ভাইভাতে গেছিলাম সেখানকার টেক্সট। মেসেজটা ওপেন করতে দেখি ভাইভা বোর্ডে আমাকে সিলেক্ট করেছে এবং কয়েকদিনের মধ্যে জয়েন দেবার জন্য বলেছে। আমি অবাক হয়ে গেলাম!  ইমন তাহলে আমাকে চাকরিতে কনফার্ম করেছে। অদ্ভূত এই ছেলেটা চাইলেই আমাকে অপমান করতে পারতো। কিন্তু সে তা করেনি। নিজেকে খুব ছোট মনে হচ্ছে। বাবাকে গিয়ে খবরটা দিলাম। যথেষ্ট খুশি হয়েছে দেখলাম। মনে পড়ে গেলো সেই ষোলো বছর আগের কথা।

তখন ক্লাস সিক্সে ছিলাম। বিভিন্ন স্কুল থেকে সব নতুন শিক্ষার্থী এসে ভর্তি হয়েছিলো। আমি ছিলাম সেখানকার স্থানীয়। ক্লাস থ্রি থেকেই সেই স্কুলের ক্যাপ্টেন ছিলাম। আর স্যারদের সাথে খুব ভালো পরিচয় ছিলো আমার। সেবার বাইরের কোনো স্কুল থেকে আমাদের স্কুলে এসেছিলো ইমন। সবসময় হাসিখুশি থাকতো। সবার সাথে এতো বেশি মিশে গিয়েছিলো যে তাকে প্রায়ই দেখা যেত বিভিন্ন সার্কেলের সাথেই মাতিয়ে আড্ডা দিচ্ছে। আমার এইসব একদম সহ্য হতো না। আমি চাইতাম সবাই আমার দিকে থাকবে। ওর সাথে কেন মিশবে! কেন ওকে সবাই এতো পছন্দ করবে! ও আমার সাথেও মিশতে আসতো কিন্তু আমি পাত্তাই দিতাম না। এর মাঝেই ক্লাস ক্যাপ্টেন নির্বাচন চলে আসলো। সবাই মিলে ওকে দাঁড় করিয়ে দিলো। এমনকি ও ক্লাস ক্যাপ্টেন হয়ে গেলো। আমি ওকে একদমই নিতে পারছিলাম না। সবসময়ই চেষ্টা করতাম ওকে জব্দ করার।

জুলাই থেকে শুরু হলো এক্সাম। একরম দিলাম। রেজাল্টের দিন একটু টেনশনে ছিলাম। ভাবছিলাম এই ছেলেটা যদি রেজাল্টেও আমার উপরে চলে যায়! যখন রেজাল্ট প্রকাশ পেলো দেখলাম দ্বিতীয় স্থানে আছি। আমি ইমনের সিরিয়াল খুঁজতে লাগলাম। দেখলাম সে এক সাবজেক্টে ফেইল করেছে। এই ছিলো আমার সুযোগ। আমার বন্ধুরা আর আমি মিলে সেদিন তাকে খুব অপমান করেছিলাম। হয়তো সেদিন তার যোগ্যতা নিয়েও প্রশ্ন তুলেছিলাম। পরদিন থেকে ওকে আর স্কুলে দেখিনি। কিছুদিন পর শুনেছিলাম ওর মা নাকি এক্সামের সময় মারা গেছিলো। সেদিন অবশ্য নিজের উপর খুব রাগ হয়েছিলো। তারপর তার সাথে আর কখনো দেখা হয়নি আমিও তার খোঁজ নেইনি। এরপর স্কুল-কলেজ লাইফ শেষ করে কোনো পাবলিক ইউনিভার্সিটিতে চান্স পাইনি। শেষমেশ একটা প্রাইভেট ইউনিভার্সিটিতে ভর্তি হলাম। ধীরে ধীরে আমার পড়াশুনার অবস্থার অবনতি ঘটতে লাগলো। বাবার একগাদা টাকা খরচ করে পড়াশোনা শেষ করেও চাকরি পাচ্ছিলাম না। আজ সেই ফেইল করা বন্ধুটা কতো বড় পদে আছে আর আমি হয়রান!

পরদিন অফিসে গেলাম চাকরিতে জয়েন করতে। আমাকে পিছন থেকে কে যেন ডাকলো। তাকিয়ে দেখি ইমন,

-জ্বী স্যর, বলেন।

-আমাকে তুমি স্যার না। ইমন বলেই ডাকতে পারো।

-আসলে আমি একটা কথা বলতে চাই। আমার সেই ব্যবহারের জন্য আমি খুবই দুঃখিত। আমাকে ক্ষমা করে দিও।

-এখানে ক্ষমা চাওয়ার কিছু নেই। আসলে তোমার জন্যই বলতে পারো আমি এতদূর এসেছি। সেদিন তুমি যদি আমাকে ওই কথাগুলো না বলতে হয়তো আমার ভিতরে সেই আত্মসম্মানবোধটা জাগতো না। আমি বিদেশে স্কলারশিপ নিয়ে পড়তে যেতাম না। আবারও হয়তো ফেইলই করতাম!  তাই আবারও আমার সেই আত্মসম্মানবোধটা জাগানোর জন্য আমি তোমার কাছে কৃতজ্ঞ।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Back To Top