উদ্দেশ্য-সুমাইয়া তানজিল

গোধূলির লাল আভা চারিদিকে ছড়িয়ে পড়েছে। আকাশটা মনে হয় আজ একটু বেশিই সুন্দর। চারিদিকে পাখিরা তাদের নীড়ে ফিরছে। তাদের সমস্ত দিনের ক্লান্তি শেষে এখন তাদের বাড়ি ফেরার সময়। কতো পাখির বাসায় ছোট ছোট বাচ্চারা অপেক্ষা করছে তাদের মায়ের জন্য। অবশেষ সব কিছুর অবসান ঘটিয়ে তারা ফিরে যাচ্ছে নিজ বাসাতে। চারিদিকে কুঁয়াশা ঘনিয়ে এসেছে। ঝিঁঝি পোকার ডাকে চারিদিক মুখিয়ে আছে। একটু পরই হয়তো শেয়াল ডাকা শুরু করবে। এরিই মাঝে দূর থেকে ভেসে আসলো মুয়াজ্জিনের কন্ঠস্বর। যেন সেই কন্ঠ সবাইকে হাতছানি দিচ্ছে মসজিদের দিকে। যেন এক মায়ার জাল বিছিয়ে দিচ্ছে। এই সবকিছুকে উপেক্ষা করে পুকুরঘাটে সেই একিইভাবে বসে থাকলো তুষার। যেন এই পৃথিবীর সবকিছুই তার কাছে বিরক্তিকর লাগছে। আবার তার সকালের কথা মনে হচ্ছে, বাবার মুখটা ভেসে আসছে বারবার।

মোহাম্মদ আলীর একমাত্র ছেলে তুষার। যদিও এক ছোট বোন আছে উষা। মোহাম্মদ আলী একটা সরকারী কলেজের কর্মচারী। মা-বাবা আর বোনকে নিয়েই তুষারের পরিবার। তুষার এবার ঢাকা মেডিকেল কলেজে পড়ছে। বলতে গেলে বাবার ইচ্ছেতেই সে মেডিকেলে ভর্তি হয়েছে। তার ইচ্ছে ছিলো কোনো এক পাবলিক ইউনিভার্সিটিতে ভর্তি হবে। বন্ধুদের সাথে আড্ডা দিবে সারাদিন। কিন্তু বাবার ইচ্ছেতেই তাকে শেষ পর্যন্ত মেডিকেলে ভর্তি হতে হয়। আর যাই হোক তার বাবার ইচ্ছে সে ডাক্তার হবে। ঢাকাতে গিয়ে প্রথম প্রথম তার পরিবারের জন্য খুবই মন খারাপ হতো। এক বছর থাকতে থাকতে অনেকটাই নিজেকে মানিয়ে নিয়েছে সে। তাছাড়া তার বেশকিছু বন্ধুও হয়েছে। তাদের সাথে মাঝে মাঝে সময় কাটাতে ভালোই লাগে তার। মাঝে মাঝে পড়ার খুব বেশি চাপ পড়লে তার বাবার উপর খুব রাগ হয়। কেন যে তাকে এখানে পাঠালো! পরে আবার মনে পড়ে তার বাবা তাকে এতো কষ্ট করে বাহিরে রেখে পড়ালেখা করাচ্ছে। তাকে নিয়ে অনেক বেশি স্বপ্ন তার বাবার। আবার সে পড়ায় নজর দেয়।

সকালে কলেজে গিয়ে ছুটির নোটিশ পেয়েই খুব খুশি হয় তুষার। অনেকদিন থেকেই ভাবছে বাসায় যাবে। মা-বাবা বোনকে নিয়ে সে নানা বাড়িতে ঘুরতে যাবে। অনেকদিন কোথাও একসাথে ঘুরতে যাওয়া হয় না। সেদিনের মতো বন্ধুদের সাথে আড্ডা দিয়ে রুমে ফিরে আসে সে। একটু পড়ে সন্ধ্যার দিকে ঘুমিয়ে পড়ে সে। যখন ঘুম ভাঙে দেখে রাত দেড়টা বাজে। খালাতো ভাইয়ের ফোনে তার ঘুম ভাঙে। এতোদিন পর আবার এতোরাতে ফোন করতে দেখে সে খুবই অবাক হয়ে গেলো। ঘুম ঘুম চোখে সে ফোন রিসিভ করে-

-হ্যালো, তুষার।

-হ্যাঁ ভাইয়া বলো, কেমন আছো?

-ভালো। তুই কাল সকালেই বাসাতে চলে আসবি। যতো তাড়াতাড়ি সম্ভব।

-কেন ভাইয়া? কি হয়েছে বলো। কারো কিছু হয়েছে নাকি? কি হলো ভাইয়া বলো।

-না, তেমন কিছু না। তুই আয়।

-বল ভাইয়া, কি হয়েছে?

-আরে তেমন কিছুই না। তোর বাবা একটু অসুস্থ।

-বাবা! কি হয়েছে বাবার? কেন হঠাৎ অসুস্থ?

-তুই বাসায় আসলেই সব শুনিস এখন রাখি।

ভাইয়ার কথা শুনে তুষারের মাথায় আবোল তাবোল ভাবনা শুরু হলো। কি হয়েছে বাবার! বাবা তো সুস্থই ছিলো। তেমন তো কোনো অসুখ ছিলো না। তবে হঠাৎ কি হলো। তুষার তার মায়ের নাম্বারে ফোন করলো। ছোট বোন ফোন ধরলো। চারপাশে খুব শোরগোল শোনা যাচ্ছিলো। কান্নাও করছিলো সবাই খুব। কোনোমতে তাকে বুঝিয়ে ফোন রাখলো তুষার।

রাতটা কোনোভাবে পার করে ভোরেই বাড়ির দিকে রওনা দিলো তুষার। বাড়ির খুব কাছে আসতেই বেশ কিছু মানুষ দেখলো সে। বাড়িতে ঢুকতেই অনেক মানুষ! তুষারের নিশ্বাস আটকে যাচ্ছে সে আর কিছু ভাবতেই পারছেনা। তবে কি বাবা..?  না এটা হতে পারে না। বাড়ির ভেতরে ঢুকে দেখলো কারো একটা লাশকে ঘিরে সবাই কান্না করছে। তার মাকে তো কোথাও দেখছে না। বোনটা কোথায় গেলো?  কিন্তু এটা কার লাশ!  লাশের কাছে যেতেই তার খালাতো ভাই তাকে জড়িয়ে ধরে কান্না শুরু করে দিলো। তুষার বার বার জিগেস করছিলো কেন তোমরা কান্না করছো?  কে মারা গেছে?  কি হলো বলো। লাশের উপর থেকে কাপড়টা সরিয়ে দেখে তার বাবা! তার বিশ্বাস হতে চাইছিলো না। তার মনে হচ্ছিলো সে যা দেখছে সব কোনো স্বপ্ন। এই মুহূর্তেই স্বপ্ন শেষ হয়ে যাবে। ঘুম ভেঙে দেখবে সব ঠিক আছে। চিৎকার করে অজ্ঞান হয়ে যায় তুষার।

চোখে মুখে পানির ছিঁটা পড়তেই হুঁশ ফিরে তুষারের। এখন কিভাবে চলবে তাদের সংসার? ি নজের পড়ালেখা, ছোট বোনের পড়ালেখা!  সে ভেবেছিলো ছুটিতে বাড়ি গিয়ে সবার সাথে নানা বাড়িতে বেড়াতে যাবে। কিন্তু তাকে যে বাবার লাশ কবরে নামাতে হবে এমন কথা সে ভাবতেই পারেনি।

বাবার জানাযা শেষ বাবাকে কবর দিয়ে কবরের পাশেই বসে রইলো তুষার। তার মাথা ঝিম ধরে গেছে। কি হবে এখন তার? কি হবে তার ফ্যামিলির? কে দেখবে তার ছোটবোন আর মাকে?  চারিদিকে অন্ধকার নেমে আসছে। তুষার উঠে দাঁড়ালো। চোখের পানি মুছে নিজেকে বলে আমার হার মানলে চলবে না। আমাকে আরও শক্ত হতে হবে। সব চিন্তা ঝেড়ে ফেলে দিয়ে নিজের সব উদ্দেশ্যকে সাথে নিয়ে বাড়ির পথে হাঁটতে শুরু করলো।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Back To Top