নিয়তি-সুমাইয়া তানজিল

আজ একদম বাজে রকমের গরম পড়ছে। বাইরের কড়া রোদ যেন ছাদ ভেদ করে চলে আসছে। মাথার উপরে ফ্যান চলছে ফুল স্পিডে। তবুও যেন মনে হচ্ছে ফ্যানের বাতাস থেকেই গরম বাড়ছে। এই গরমে যে জানালাটা খুলে বসবো তার উপায়ও নেই। যেন জানালা খুললেই এক ঝলক আগুন রুমে ঢুকে যাবে। তবুও উপায় নেই। খাতা কলম নিয়ে বসে পড়লাম জানালাটা খুলে। বাতাস যা একটু আছে এটাই এ গরমে শান্তি। এক ঝলক বাইরে তাকালাম। বাইরের পরিবেশটা একটা থমথমে ভাব। কোনো জনমানব নেই। হয়তো দূরে অবয়ব দেখে মনে হচ্ছে কেউ একজন ছাতা নিয়ে যাচ্ছে। যাক তাও একজনকে দেখলাম যে এতো রোদেও আমার মতো বিপদে পড়েছে। যাই হোক আমি আমার লেখায় মনোযোগ দেই। মাসের পাঁচ তারিখের মধ্যে পান্ডুলিপি জমা দিতে হবে প্রকাশক বলে দিয়েছে। অথচ এই দুইদিন থেকে বারবার খাতা নিয়ে বসেও দুই থেকে তিনটা শব্দ তো দূরের কথা বরং কোনো আইডিয়াই মাথায় আসছে না। আজকে লিখতেই হবে। খুব সিরিয়াস হয়ে লিখতে বসে গেলাম।

মাত্র লিখতে শুরু করবো এমন সময়েই কোথায় থেকে এক মেয়ে রুমে চলে আসলো। ধরপড় করে এসে ফ্লোরে বসে পড়লো। আমি অবাক হয়ে তাকিয়ে দেখলাম এতো গ্রামের সেই মেয়েটা। সুখী না কি যেন একটা নাম। গ্রামের সবাই বলে মাথা খারাপ। শুনেছি কোনো এক রোগে তার মা-বাবা সবাই মারা গেছে। কোনো এক কারণে হয়তো ভাগ্যের জোরেই সে একা বেঁচে গেছে। নিজের চোখের সামনে পরিবারের সবাইকে কবরে নামতে দেখে আর সুস্থ থাকতে পারেনি সে। তাই এখন আমি মহাবিপদে পড়ে গেলাম। এমনিতেই খুব মনোযোগ দিয়ে মাত্রই গল্প লিখতে শুরু করেছি এর মাঝেই হঠাৎ করে এসে একটা অস্বস্তিতে ফেলে দিয়েছে। ভাবলাম পানি খেয়েই চলে যাবে। আবার একটু শান্তির ঢেঁকুর তুলে স্থিরভাবে বসেছে। আবার এইসব প্রশ্ন শুরু করেছে। যাই হোক কোনোমতে বিরক্তিভাব নিয়ে প্রশ্নের উত্তর দিলাম, এইতো মানে তেমন কিছুই না। গল্পের প্লট খুঁজছিলাম।

গ্রামের আনাচে-কানাচে ঘুরে বেড়ায় আর মানুষকে ধরে আবল-তাবল প্রশ্ন করে। আমার সাথে যদিও তার এর আগে কখনও কথা হয়নি। এই রকম সময়ে ঘরের ভেতরে একটা মেয়ের আসা দেখে অস্বস্তি বোধ করতে লাগলাম। একটু থেমে মেয়েটা আমাকে বললো, একটু পানি দেন তো। আমি তাকে এক গ্লাস পানি এনে দিলাম পানিটা একবারে খেয়ে সে নিজেই বলতে শুরু করলো, বাইরে এতো গরম পড়ছে। চারিদিকে কোথাও পানি নেই। একটু পানি পেয়ে বাঁচলাম। যাক বাবা। তা তুমি করছো কি এতো মনোযোগ দিয়ে?

-গল্প লিখতে আবার এতো ভাবতে হয় নাকি। এইসব অযথাই ভাব নেওয়া। মনে হয় যেন খাতা-কলম নিয়ে একটু চোখ বন্ধ করে না ভাবলে গল্প লেখা যায় না। যাই হোক কাজের কথায় আসি। আমাদের চারিদিকেই অনেক গল্প ছড়িয়ে আছে। এই যেমন মনে করো, বাইরে দুটো লোক যাচ্ছে। হতে পারে তার কোনো একটা বড় বিপদ হয়েছে। এমনও তো হতে পারে যে তার ছেলে-মেয়ে বা মা-বাবা অসুস্থ। তার জন্য সে ঔষুধ নিতে এই কড়া রোদে ডাক্তারের কাছে যাচ্ছে। এটা নিয়েও গল্প লিখতে পারো। মনে করো ঔষুধ নিয়ে যেতে যেতে একটু দেরি হয়ে গেছে। যখন সে বাড়ি গিয়ে পৌঁছাবে, গিয়ে দেখবে হয়ে  তা মারা গেছে অথবা এমন একটা গল্পও হতে পারে মনে করো….।

আমি একসময় যথেষ্ট বিরক্ত হয়ে গেলাম। তবুও মনোযোগ নিয়ে কথা শুনতে হচ্ছিলো।

-জ্বী।

আচ্ছা ধরো যুদ্ধ হচ্ছে একটা দেশে। সেই দেশের মানুষ তাদের দেশ ছেড়ে অন্য এক জায়গায় চলে যাচ্ছে। তার জন্য তাদের পাহাড় পেরুতে হবে। অনেক উঁচু উঁচু পাহাড়। সবাই সবার ব্যাগ বস্তা বেঁধে নিয়ে পাড়ি দিচ্ছে পাহাড়ের পর পাহাড়। কেউ কেউ তাদের লম্বা লম্বা পা নিয়ে পাহাড়ের দিকে এগোচ্ছে। ভাবতে পারো এই তীব্র রোদে তাদের কি অবস্থা। কেউ হয়তো পাহাড়ে উঠতে পেরেই সেই উপত্যকায় শুয়ে পড়েছে। আবার কারো পা চলছে না। তবুও টেনে হিঁচড়ে উঠার চেষ্টা করছে। তারা কেউ কেউ ওইখানেই পড়ে মারা যাচ্ছে। তার মৃত্যুতে অনেকেই ভাবছে, যাই হোক অন্তত সব কষ্ট থেকে বেঁচে গেলো লোকটা। একবার ভাবো, কি একটা অবস্থা?  ভাবতেই চোখ বন্ধ হয়ে আসে।

হঠাৎই উঠে দাঁড়ালো। মনে হলো তার অনেক তাড়া। ব্যস্ত হয়ে বললো এতো ভেবে কাজ নেই। আচ্ছা, আমি কোথায় যাচ্ছিলাম বলো তো?

আমি বিপদে পড়লাম। কি বলবো বুঝতে পারছিলাম না। আমতা আমতা করতে লাগলাম।

-তুমি তো কিছুই জানো না। তোমাকে দিয়ে গল্প লিখা হবে না। তোমার সাথে বকবক করে কোনো লাভ নেই। আমার অনেক কাজ আছে। আমি যাই। আর হ্যাঁ, গল্প লাগলে আমাকে বইলো আমি আরও ভেবে তোমাকে বলবো। এখন উঠি।

আমি নিস্তব্ধ হয়ে গেলাম। মুহূর্ত কয়েক মনে হলো যেন জমে গেছি। যখন বাস্তবে ফিরলাম তখন মনে হলো যেন কয়েক মিনিট একটা ঝড় মাথার উপর দিয়ে চলে গেলো। আমি এক গ্লাস পানি খেয়ে আবার গল্প লেখায় মনোযোগ দিলাম।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Back To Top