উফফ! বিরক্তিকর জ্যাম। ইচ্ছে করে মাঝে মাঝে এই ঢাকা শহর ছেড়ে কোন এক নির্জন জায়গায় চলে যাই। যেখানে অন্তত এই রকম লোকালয় আর বিরক্তিকর জ্যাম থাকবে না। মনে হয় বাংলাদেশের অর্ধেক মানুষই যেন ঢাকা শহরে বাস করে। এদিকে আমার অফিসের দেরি হয়ে যাচ্ছে। আজকেও দেরি করলে বসের কি পরিমাণ ঝাড়ি শুনতে হবে ভেবে এই গরমে আরও বেশি ঘেমে যাচ্ছি। গাড়ির এসিও কাজ করছে না সকাল থেকে। আধঘন্টা থেকে জ্যামে বসে আছি। যদিও এটা কিছুই না। আরও কতক্ষণ থাকতে হবে একমাত্র আল্লাহই জানে।
গাড়ির গ্লাসটা নামিয়ে দিলাম। এমন সময় কোথা থেকে একটা ছোট মেয়ে আসলো আমার গাড়ির কাছে। বাইরে থেকেই চিৎকার করতে লাগলো ভাইয়া একটা ফুল নিবেন? একটা ফুল নেন না। আমি সকালে কিছু খাইনি। একটা ফুল নেন ভাইয়া। আমার মেজাজটা বিগড়ে গেলো। এমনিতেই আমার চাকরি যাওয়ার চিন্তা তার ওপর এতক্ষণ থেকে বসে আছি জ্যামে। কি যে বিরক্তি তার উপর এই মেয়ে এসে বিরক্ত করছে। কোনভাবেই যাচ্ছে না। আর এই জ্যামটাও ছাড়ছে না। মেয়েটা আবার বকতে লাগলো ভাইয়া একটা ফুল নিন না। আপনার মাকে দিয়েন। খুব খুশি হবে।
আমি অবাক হয়ে তাকিয়ে থাকলাম। এটা প্রতি দিনের ঘটনা। যখনই জ্যামে বসে তখনই সব ছোট ছোট মেয়ে, ভিখারি এসে হাজির হয়। কিন্তু মজার ব্যাপার হলো সব মেয়েরা এসে বলে আপনার প্রেমিকার জন্য নিয়ে যান নয়তো বলে ম্যামের জন্য নিয়ে যান। প্রথমবার এমন কথা শুনলাম। আমি যথেষ্ট অবাক হয়ে গেলাম। মেয়েটার দিকে দেখলাম অনেক ছোট। আর অনেক সুন্দর দেখতে। মাথার চুলগুলো রুক্ষ হয়ে গেছে। মুখ ফ্যাকাশে হয়ে আছে। যেন অনেক্ষণ থেকেই খাওয়া হয় নাই তার। এর মাঝেই গাড়িটা ছেড়ে দিলো। আমি একটু আনমনা হয়ে গেছিলাম। আবার সামনের দিকে মনোযোগ দিলাম।
অফিসে পৌঁছাতে ১৫ মিনিট দেরি হয়ে গেছে। ঢুকতেই বসের তলব। বুঝছি আজ কপাল খারাপ আছে। ভয়ে ভয়ে বসের কাছে গেলাম। যেতেই যেন দুই মিনিটের একটা ঝড় বয়ে গেলো। ভালোভাবেই বুঝলাম এইবার যদি দেরি করি তবে আর চাকরি থাকবে না। কিন্তু আমি কি ইচ্ছে করে দেরি করি নাকি। জ্যামে পড়লে আমার কি দোষ। বস কোন ভাবেই মানতে চাইবে না। যত্তসব!
সকাল সকাল বসের ঝাড়ি শুনে খুবিই বিরক্তি লাগছে। মনে হচ্ছে এই চাকরি করার থেকে না করাই ভালো। সারাদিন বসের ঝাড়ি খাও আবার খেটে মরো। তার উপর আবার আমি বসের পিএ। যাই হোক কাজে মনোযোগ দিই।
এর মাঝে অনেকগুলা দিন কেটে গেছে। সেই বাচ্চাটাকে আর দেখি নাই আর গাড়ির কাছে। একদিন অবশ্য দূরে দেখেছিলাম।
বাসায় সব সময় এইসব আর ভালো লাগে না। সুমি আমার মাকে যেন একদম সহ্য করতেই পারে না। মায়ের সব কিছুতেই তার সমস্যা। সারাদিন কাজ করার পর ক্লান্ত হয়ে বাসায় ফিরে তার ওপর আবার এইসব কথা। তোমার মা আজ এইটা করছে ওইটা করছে। বিরক্তি নিয়ে বাসা থেকে বের হয়ে আসলাম। রাস্তার পাশ দিয়ে আনমনে হাঁটছি।
হঠাৎ সেই জায়গায় দেখি মেয়েটা বসে আছে। ফুল দিয়ে যতসম্ভব মালা গাঁথছে। আমি তার কাছে গেলাম। আমাকে দেখেই একটু হাসলো। কত্তো মিষ্টি হাসি। দেখেই ভালো লাগছে। ওর পাশে গিয়ে বসলাম। দেখি খুব মন দিয়ে মালা গাঁথছে বকুল ফুল দিয়ে।
-কি নাম তোর?
-আমার নাম ফুলি। তোমার নাম কি?
-উরে বাবা! সাহস তো কম না। তুই আমাকে নাম জিজ্ঞেস করছিস। আমি তোর বড় না।
তুমি তো আমাকে নাম জিজ্ঞেস করলে। তাই আমিও করলাম। কেন তুমি জানো না কেউ কিছু জানতে চাইলে তাকে উত্তর দিয়ে সেটা তার থেকেও জানতে চাইতে হয়। যেমন কেউ যদি বলে কেমন আছো? ভালো আছি বলে তাকেও জিজ্ঞেস করতে হয়। আমার মা শিখিয়েছে।
-বাহ! তুই তো ভালোই কথা জানিস। থাকিস কোথায়?
এইতো পাশের বস্তিতে।
-তোর মা বাবা কি করে?
মা বাবা! আমার তো মা বাবা কেউই নেই।
কেন কোথায় থাকে তারা?
বাবা তো আমাকে ছেড়ে গেছে সেই কবেই। তারপর মায়ের সাথেই ছিলাম। মা একজনের বাসায় কাজ করতো আর আমি ফুল বেচতাম। একদিন মা কাজ করতে গেছিলো আর আমি আসছিলাম ফুল বিক্রি করতে। এক সময় রেনু এসে আমাকে বলে আমার মা মারা গেছে। তারপর বাসায় গিয়ে দেখি মা ঘুমিয়ে আছে। মাকে সবাই মিলে কবর দিয়ে দেয়। তারপর থেকে আমরা কয়েকজন বাচ্চা একসাথে থাকি।
আমি কিছুক্ষণ ওর মুখের দিকে তাকিয়ে রইলাম। কি নিষ্পাপ একটা মুখ। এর মধ্যেও এতো কষ্ট। অনেক সুন্দর দেখতে। কোন ধনী পরিবারে জন্ম নিলে হয়তো রাজকন্যা হয়ে থাকতো। যত্নের অভাবে রুক্ষ হয়ে গেছে চেহারা। তবুও দেখে মনে হচ্ছে কোন এক শিল্পী নিঁখুত ভাবে ফুটিয়ে তুলেছে একটা ছবি।
সন্ধ্যা হয়ে আসছে। সূর্য অস্ত যাবে দেখেই মনে হচ্ছে। হঠাৎ ফুলি উঠে দাঁড়ালো।
-আমি এখন আসি। মায়ের কবরে যেতে হবে।
-মায়ের কবরে কেন এখন?
-ফুল দিতে। মা মারা যাবার পর প্রতিদিন আমি ফুল দিই কবরে। ফুল দিয়ে বলি মা আমি তোমাকে অনেক ভালোবাসি। আমি জানি আমার মা অনেক খুশি হয়।
-আমাকে এই ফুলের মালা টা দে। আমার মাকে দিবো।
-নাহ এইটা দেওয়া যাবে না। বকুল আমার মায়ের প্রিয় ফুল। তুমি অন্য একটা নাও।
কয়েকটা ফুল নিলাম। ওকে কিছু টাকা দিয়ে বাসায় চলে আসলাম। এসে দেখি মা রুমে বসে আছে। দেখে মনে হচ্ছে চিন্তায় আছে।
-আমাকে দেখেই বলতে শুরু করলো কই ছিলি বাবা? আমার কতো চিন্তা হচ্ছিলো। এইভাবে আর কখনো যাবি না। সমস্যা হইলে আমি যাবো। তাও রাগ করিস না বাবা।
আমি মাকে ফুলটা দিয়ে বললাম,
– আমি তোমাকে ভালোবাসি মা।
মা কান্না করে আমাকে জড়িয়ে ধরলো। বললো পাগল ছেলে মাকে কি ভালোবাসি বলতে হয় নাকি! মায়েরা বুঝে ছেলেরা তাদের কতো ভালোবাসে।
আমি ভাবলাম কাল ফুলি কে গিয়ে বলবো,
“ফুলি আমার মাও খুব বকুল ফুল ভালোবাসে। তুই কি আমার মায়ের মেয়ে হবি। বেশি কিছু না। প্রতিদিন একটা করে বকুলের মালা এই মায়ের জন্যও গেঁথে দিস। “