রাত দুইটা। চারিদিকে সব নিস্তব্ধ। একদম শান্ত পরিবেশে পরীক্ষার প্রিপারেশন নিচ্ছে রাতুল। রাতুল এবার অনার্স প্রথম বর্ষের স্টুডেন্ট। কাল তার ইয়ার ফাইনাল পরীক্ষা সেই জন্যই এতো রাত জেগে পড়া। এই শান্ত পরিবেশকে হঠাৎই একটা শব্দ ভেঙ্গে খান খান করে দিলো। ঘুম ঘুম চোখে ফোনের শব্দ শুনে চমকে উঠলো রাতুল। কিছুটা ঘাবড়ে গেলো সে। ফোন হাতে নিয়ে দেখে তার বন্ধু অনিক ফোন করেছে। এতো রাতে অনিকের ফোন দেখে রাতুল কিছুটা অবাক হয়ে যায়। ফোন রিসিভ করতেই অনিক বলে উঠে,
-দোস্ত তোর রক্তের গ্রুপ বি পজেটিভ না?
-হ্যাঁ, কেন?
-রিফাত এক্সিডেন্ট করেছে। আমরা হসপিটালে আছি। ওর অনেক রক্তের প্রয়োজন কিন্তু কোথাও রক্ত পাওয়া যাচ্ছে না। দোস্ত তুই এক ব্যাগ রক্ত দে না।
একসাথে এতগুলো কথা বলে অনিক দম নেয়। কথা শুনে মনে হচ্ছে কান্না করছে। রিফাত তারই ক্লাস ফেন্ড। ছেলেটা একটু বখাটে। শুধু বাইক নিয়েই ঘুরে। এতো স্পিডে বাইক চালানোর জন্য তাকে অনেকেই বকেছে ও কারো কথাই কানে নেয়নি। রাতুলের মনে পড়ে সেও একদিন বলেছিলো, এতো জোরে বাইক চালাইস না। যেদিন এক্সিডেন্ট হবে সেদিন বুঝবি। কিন্তু আজ ওর কথা ভেবে খারাপ লাগছে। এইদিকে সে রক্ত দেওয়ার কথা ভাবতেও পারে না। তার এসব মেডিক্যাল যন্ত্রপাতি দেখলেই ভয় করে। তার উপর আবার কতোক্ষন যাবত তার হাতের মধ্যে সুঁচ ঢুকানো থাকবে ভাবতেই তার গায়ের লোম দাঁড়িয়ে যায়। সে এতটাও বড় হয়নি যে রক্ত দিবে। সে একটু ভেবে বলে-
-ইয়ে মানে দোস্ত। তুই তো জানিস, আমার এসব যন্ত্রপাতি দেখলেই ভয় করে। তার উপর আবার রক্ত দেওয়া আমি এটা পারবো না। অন্যদিকে দেখ পেয়ে যাবি। আর আমিও খুঁজে দেখছি। পেলে তোকে জানাবো।
-না থাক, আমরাই খুঁজে নিবো। শুধু একটা কথাই বলতে পারি, বন্ধু মানে একে অপরের বিপদে সাহায্য করা। একে অপরের জন্য ত্যাগ করা। তুই আজকে একজনকে সাহায্য করছিস না। কাল তুইও তো বিপদে পড়তে পারিস। তাই আমাদের একে অপরের সাহায্য করাটা উচিত।
-(রাতুল আমতা আমতা করে বলে)আমি দুঃখিত ভাই, দোয়া করি রক্তের জোগাড় হয়ে যাবে।
-ধন্যবাদ ভাই রাখি।
পরেরদিন সকালে ঘুম থেকে উঠেই রাতুলের রিফাতের কথা মনে পড়লো। সাথে সাথেই সে অনিককে ফোন দিলো। অনিক ফোন রিসিভ করছে না। অনেক্ষন পর রিসিভ করে অনিক কাঁদতে থাকলো। কিরে কি হয়েছে? বলবি তো? ি রফাত কেমন আছে? সুস্থ তো এখন?
-ও কাল রাতেই মারা গেছে। কোথাও রক্ত পাওয়া যায়নি। বলেই অনিক আবার কান্নায় ভেঙ্গে পড়লো।
রাতুল কি বলবে বুঝতে পারছে না। একদম নিস্তব্ধ হয়ে গেলো সে। অনিকের ফোন কেটে দিয়ে একদম থমকে যায় ও। কি হতো একব্যাগ রক্ত দিলে। না হয় একটু ব্যাথাই হতো। কিন্তু একটা জীবন তো বেঁচে যেতো। অনিকের কাল রাতের বলা কথাগুলো ওর কানে বাজতে থাকে। কেমন যেন ভিতরে মোচড় দিচ্ছে। হঠাৎই ভীষণ কষ্ট হচ্ছে। হাত দিয়ে মুখ ঢেকে রাতুল কান্না করতে শুরু করলো।
তিন মাস পর একদিন কলেজ শেষ করে বাড়িতে ফিরছে রাতুল। এর মাঝে আর রিফাতের কথা মনে হয়নি। আজ কেন যেন রিফাতের কথা মনে হচ্ছে। রিফাতের কথা ভাবতো ভাবতে বাড়ির সামনে চলে আসে রাতুল। এসে শুনে বাড়ির ভেতরে কান্না করছে কেউ। রুমে গিয়ে শুনে ওর ছোট বোন বেড থেকে পড়ে গিয়ে প্রচুর রক্তক্ষরণ হয়েছে। তাকে হসপিটালে নিয়ে যাওয়া হয়েছে। রক্ত লাগবে অনেক। কোথাও রক্ত খুঁজে পাওয়া যাচ্ছিলো না। রাতুল পাগলের মতো চারিদিকে রক্ত খুঁজতে থাকে। নিজেকে আজ অনেক অপরাধী মনে হচ্ছে তার। সেদিন রিফাত কে কেন সাহায্য করেনি এই ভেবে তার প্রচুর কান্না পাচ্ছিলো। অনিক ঠিকই বলেছিলো। বিপদ মানুষের যেকোনো সময় আসতে পারে। রাতুল কিছুই বুঝতে পারছে না কি করবে। সন্ধ্যা হয়ে আসছে। রাতুল অসহায়ের মতো পার্কের বেঞ্চে বসে কান্না করতে থাকে। তার ফোন বেজেই যাচ্ছে কিন্তু তার কোনো খেয়ালই নেই। সে ফোনটা হাতে নিয়ে দেখে তার মা ফোন করেছে। ফোনটা আবার পকেটে রেখে দেয়। সে জানে তার মা জিগেস করবে রক্তের ব্যবস্থা হলো কিনা। সে কি জবাব দিবে। না সে আর কিছুই ভাবতে পারছে না। একসময় উঠে পড়ে হসপিটালের দিকে হাঁটতে থাকে। গিয়েই দেখে তার বোন ঘুমাচ্ছে। পাশে তার মা। তার মা তাকে দেখেই বলে-
-কিরে কই ছিলি তুই? আমি সেই কখন থেকে ফোন করেই যাচ্ছি।
-রক্ত পাওয়া গেছে?
-হ্যাঁ, একটা ছেলে এসে দিয়ে গেছে একটু আগে।
রাতুলের যেন নিশ্বাস প্রায় বন্ধ হয়ে গেছিলো। এখন একটু স্বস্তি পাচ্ছে।
-রাতুল জিগেস করলো, কোথায় সেই ছেলে?
-মা বললো, বাহিরেই বসে আছে দেখ।
রাতুল বাহিরে গিয়ে দেখলো কেউ নেই। শুধু বেঞ্চে একটা চিরকুট, হাতে নিয়ে দেখে সেখানে লিখা-
“বিপদ মানুষের যেকোনো সময় আসতে পারে, আমাদের সবার উচিত সবার বিপদে সাহায্য করা।”
রাতুলের চোখ দেখে দু’ফোঁটা পানি পড়লো। তার মনে হচ্ছিলো সেই লেখার মধ্যে সে রিফাতকে স্পষ্ট দেখতে পাচ্ছিলো।